‘জীবনে সঙ্গ অনেক বড় ব্যাপার’

এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা হয়নি। তবে ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে এসেছেন আলোর দেশে। বয়স মাত্র ২৩ বছর বলে সামনে এখনো অসীম সম্ভাবনা।...

এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা হয়নি। তবে ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে এসেছেন আলোর দেশে। বয়স মাত্র ২৩ বছর বলে সামনে এখনো অসীম সম্ভাবনা। কাল সকালে চট্টগ্রামের হোটেল র্যাডিসন ব্লুর লবিতে বসে তারেক মাহমুদকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিপিএলের দল চিটাগং ভাইকিংসের পেসার মোহাম্মদ আমির জানালেন তাঁর নতুন করে ফেরার স্বপ্ন আর গত পাঁচ বছরের সংগ্রামের কথা। ২০১০ সালের স্পট ফিক্সিং নিয়ে কোনো কথা বলবেন না—এমন শর্তেই সাক্ষাৎকার দিতে বসেছিলেন পাকিস্তানের এই পেসার।

* বিপিএল কেমন উপভোগ করছেন?
মোহাম্মদ আমির: ভালোই। পাঁচ বছর পর ক্রিকেট খেলছি, উপভোগ করার এটাই হয়তো মূল কারণ। বহিষ্কারাদেশ উঠে যাওয়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেও আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট বা আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলছি এই প্রথম। আর ক্যারিয়ারে এই প্রথম বিদেশের মাটিতে কোনো লিগ খেলছি। শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে ফেরার জন্য উপযুক্ত একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি।
* ভালো বোলিং করছেন এই টুর্নামেন্টে। পাঁচ বছর শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে না খেলেও কীভাবে ধরে রাখলেন নিজেকে?
আমির: ফাস্ট বোলারদের জন্য কাজটা কঠিন। এক সপ্তাহ বোলিং না করলেও সব হারিয়ে যায়। আর এটা তো পাঁচ বছর! আমার প্রথম কাজ ছিল ফিটনেস ধরে রাখা। না খেললেও সব সময় অনুশীলনের মধ্যে ছিলাম, জিমে গেছি।
* বিশেষ কারও সাহায্য পেয়েছেন এই সময়ে?
আমির: এসব পরিস্থিতিতে পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। গত বছর সেপ্টেম্বরে আমি বিয়ে করেছি, তবে এখনো অনুষ্ঠান হয়নি। আগামী বছর হবে। বিয়ের পর থেকেই স্ত্রী আমাকে অনেক সাহায্য করছে। কঠিন ওই সময়টাতে কিছু ভালো বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তারাও অনেক অনুপ্রেরণা দেয়। ক্রিকেটের বাইরে চলে গিয়েছিলাম...সময়টা খুব কঠিন ছিল আমার জন্য। বন্ধুদের কথা বিশেষভাবে বলব। পরিবার তো সব সময় আপনার পাশে থাকবেই। কিন্তু এ রকম খারাপ সময়ে কয়েকজন ভালো বন্ধুও পেয়ে গেলে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি।
* মাইক আথারটন সব সময়ই আপনার পাশে ছিলেন। এ রকম আর কোন কোন ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বকে কাছে পেয়েছেন সেই দুঃসময়ে?
আমির: আথারটন তো এখনো সাহায্য করছেন। মাইক হোল্ডিংও অনেক সাহায্য করেছেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে কেউ যদি আমার হয়ে দুটি ভালো শব্দও বলেন, আমার জন্য তা অনেক বড় ব্যাপার। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতার—সবাই আমার পাশে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। যারা দুঃসময়ে পাশে থাকে, তারাই আসল শুভাকাঙ্ক্ষী।
* ওয়াসিম আকরাম একবার বলেছিলেন, ১৭-১৮ বছর বয়সে উনিও আপনার চেয়ে ভালো বল করতেন না। কীভাবে নিয়েছিলেন ওই প্রশংসা?
আমির: এটা আমার জন্য ছিল অনেক বড় পাওয়া। তিনি আমার আদর্শ। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি যে, উনি আমার ব্যাপারে ওই কথা বলেছেন। ওয়াসিম আকরামের মতো বোলার পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আসবে না। তাঁর মতো কিংবদন্তির মুখ থেকে এ রকম কিছু শোনাটা আমার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
* কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজে কী করেছেন?
আমির: সব সময় সবকিছু ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে ভেবেছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল আত্মবিশ্বাস। আমি ভুল স্বীকার করেছি এবং ভুল থেকে শিখেছি। আবারও জাতীয় দলে খেলতে পারব—এই বিশ্বাসটাই আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার জন্য। ইনশা আল্লাহ আমি আবার খেলবও।
* পাকিস্তানের মানুষ, ভক্ত-সমর্থক—এখন আপনাকে কীভাবে নিচ্ছেন?
আমির: আমার অসংখ্য ভক্ত পাকিস্তানে, তারা সব সময়ই আমাকে সমর্থন দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সবখানে তাদের উৎসাহ পাচ্ছি। সমর্থকেরা আমার জন্য দোয়া করে, আমিও তাদের জন্য দোয়া করি। ভক্ত-সমর্থক ছাড়া আমরা কিছুই না। তাদের জন্যই আমরা তারকা।
* শপিং মল বা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে কখনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি?
আমির: সবার কাছ থেকে তো আপনি ভালোবাসা পাবেন না! কিছু মানুষ আপনাকে পছন্দ করবে, কিছু মানুষ করবে না। তবে আমি যেটা জানি, পাকিস্তানে অনেক মানুষই আমাকে ভালোবাসে। আমার জন্য দোয়া করে।
* কিন্তু পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটার তো এখনো আপনার সঙ্গে খেলতে রাজি নন। মোহাম্মদ হাফিজ তো আপনি খেলছেন বলে চিটাগং ভাইকিংসে খেলতেই এলেন না!
আমির: এ নিয়ে মন্তব্য করতে পারব না।
* কিছুদিন তো জেলও খাটতে হয়েছে আপনাকে। কেমন ছিল সে সময়টা?
আমির: ভালো ছিল, সেটা তো বলার উপায় নেই। ওটা ছিল একটা সংশোধন কেন্দ্র। আমার প্রতি তাদের আচরণ খুব ভালো ছিল। আসলে সবকিছুতেই শেখার কিছু না-কিছু থাকে। ওখানে আমাদের একজন পার্সোনাল অফিসার ছিলেন। সংশোধন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসার সময় উনি বলেছিলেন, ‘তুমি ভুল করেছ, সেটার সাজাও পেয়ে গেছ। এখন তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাচ্ছ। তোমাকে নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা নিয়ে যাও। ভবিষ্যতের দিকে তাকাও।’ তার কথা আমার জীবনে অনেক কাজে লেগেছে।
* জাতীয় দলে নিশ্চয়ই ফিরতে চান আবার। কী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন ?
আমির: পরিকল্পনা খুব সাধারণ। আমি সব সময় ছোট ছোট লক্ষ্য নিয়ে এগোনোয় বিশ্বাসী। ছোট লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারলে দিন শেষে সব লক্ষ্যই পূরণ হয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সময় আমার দৃষ্টি শুধু ওই দিকে ছিল। এখন বিপিএলে খেলছি, সব চিন্তা এটা নিয়ে। টুর্নামেন্টের সেরা বোলার হতে চাই আমি।
* জাতীয় দলে প্রথম ডাক পাওয়ার অনুভূতি কি মনে আছে এখন?
আমির: এখনো ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না সে অনুভূতি। পাকিস্তানের হয়ে খেলাটা ছিল আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ওটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। আর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনটা যখন ধরা দেবে, আপনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন। নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন মানে হলো আপনি বিশেষ কেউ। আমিও সে রকমই ছিলাম। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, ওই সম্মানটা পেয়েছিলাম।
* আর বহিষ্কার হওয়ার পর তাৎক্ষণিক অনুভূতি?
আমির: মনে হচ্ছিল আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেছে। আমি শেষ হয়ে গেছি। পরিস্থিতিটা খুব জটিল হয়ে পড়েছিল। মিডিয়ায় তোলপাড় চলছিল...পাকিস্তানি খেলোয়াড়েরা এই করেছে, ওই করেছে। আসলে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না তখন কেমন লাগছিল। অতীত নিয়ে কথা বলতে চাই না, তবে এটাও ঠিক, আমি অনেক কিছু শিখেছি ওসব থেকে। ইনশা আল্লাহ ভবিষ্যতে আমার মধ্যে একজন ভালো মানুষকেই খুঁজে পাবেন আপনারা।
* কেন জড়িয়েছিলেন এসবে? ২০১০ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়স ছিল আপনার। বিষয়টা কি এমন যে বয়সটাই ছিল মোহে পড়ার, বিভ্রান্ত হওয়ার?
আমির: হতে পারে...আমি তখন একদম নতুন। দলে যখন আপনি নতুন আসবেন, আপনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকবে না, এ রকম হতে পারে। আমার জন্য জগৎটা ছিল বিশাল। বয়স অনেক কম ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিশাল জগতে শুরুতেই সবকিছু সামলে ওঠা খুব কঠিন। ১৭ বছরের একটা ছেলের তো জানারই কথা নয় তাকে কত কিছু সামলাতে হতে পারে! ভালো খেলছিলাম, অনেক চুক্তির প্রস্তাব আসছিল...এ রকম সময়ে অনেক কিছুই বুঝে ওঠা যায় না। এখন আমি অনেক সতর্ক। বুঝি, একজন খেলোয়াড়ের একার পক্ষে সবকিছু সামলানো কঠিন। আমি তো মাঠে খেলব, কিন্তু ক্রিকেটের বাইরেও কিছু ব্যাপার থাকে। আমার যেমন এখন কয়েকজনের একটা দলই আছে, যারা মাঠের বাইরের জিনিসগুলো দেখে। এটা ওই সময়ই করা উচিত ছিল।
* এখন তো মনে হয় ‘নো’ বলের ব্যাপারেও অনেক সতর্ক আপনি...
আমির: এটা খেলার অংশ। আমি যদি মনে করি, আমার আর কোনো দিন ‘নো’ বল করা ঠিক হবে না, তাহলে আমার ক্রিকেটই খেলা উচিত না। ওয়াইড বল, নো বল—এসব ক্রিকেটেরই অংশ।
* ২০০৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সফরে প্রথম লর্ডসে গিয়েছিলেন। ওই সময় কি স্বপ্ন দেখেছিলেন?
আমির: বন্ধুদের বলেছিলাম, আমিও একদিন এখানে আসব। ৫ উইকেট নেব। সেটা করে দেখিয়েছি। আমি ছিলাম লর্ডসে ৫ উইকেট নেওয়া সবচেয়ে কম বয়সী পেস বোলার।
* আর এখন আপনার কাছে ‘লর্ডস’ মানে কী?
আমির: (হাসি)...লর্ডসে আমার ভালো স্মৃতিও আছে, বাজে স্মৃতিও আছে। পেশাদার হিসেবে আপনাকে সবকিছুরই মুখোমুখি হতে হবে। একটা অসম্ভবকে আপনি সম্ভব করবেন কি না, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করে। ব্যাটিং ট্র্যাকে যখন একজন ফাস্ট বোলারের জন্য কিছুই থাকে না, সেখান থেকে উইকেট নেওয়ার মজাই আলাদা। খারাপ জিনিসকে কীভাবে আপনি ভালো জিনিসে বদলে দেবেন, সেটা আসলে আপনার ওপরই নির্ভর করে।
* ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারদের জন্য কিছু বলবেন? বিশেষ করে ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে...
আমির: অবশ্যই। এই পাঁচ বছরে আমি শিখেছি, জীবনে সঙ্গ অনেক বড় ব্যাপার। যাদের সঙ্গে মিশবেন বা যে পরিবেশের সঙ্গে মিশবেন, সেটা ভালো হতে হবে। একজন খেলোয়াড় তার ঘরে অনেক কম সময় কাটায়। বন্ধু-খেলোয়াড়দের সঙ্গেই তাঁকে বেশি সময় কাটাতে হয়। যাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাবেন, সেই মানুষগুলো ভালো হতে হবে। কেউ যদি আপনাকে ছোট একটা ভুল কাজও করতে বলে, সে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। এমন পরিবেশে মিশুন, যেখান থেকে আপনার মধ্যে ইতিবাচক চিন্তা আসবে। যেখান থেকে ইতিবাচক চিন্তা আসে, সেখান থেকে ভালো কিছু শেখা যায়। কিন্তু যাদের সঙ্গে থাকলে বা যেখানে গেলে মনে বাজে চিন্তা আসে, দয়া করে সেখানে সময় নষ্ট করবেন না। সেটা করলে আপনি হয়তো আপনার জীবনটাই নষ্ট করে ফেলবেন।

Related

Sports Photo 7406488440844890204

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রিয় পাঠক! যদি পোস্টটি পড়ে আপনার ভালো লেগে থাকে, অথবা পোস্টটিতে আপনার সমস্যা থেকে থাকে তবে একটি গঠনমূলক মন্তব্য করার অনুরোধ করছি । কারন আপনার একটি ভালো মন্তব্য লেখককে আরো ভালো পোস্ট লেখার অনুপ্রেরণা যোগাবে। আশাকরি এমন কোন মন্তব্য করবেন না, যা পড়লে লেখকের কাছে খারাপ লাগতে পারে । সাথেই থাকুন ধন্যবাদ....

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷

emo-but-icon

পেজে লাইক দিন l

ভিজিট করেছেন

550,193
item